اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .১। আয়াত
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنْتَ لَهُمْ ط وَلَوْكُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ص فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِى الاَمْرِ ج فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ ط اِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি নম্ন হয়েছো। যদি তুমি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে তারা তোমার চারদিক থেকে সরে যেতো। অতএব তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাদের জন্য ইসতিগফার কর এবং সামষ্টিক বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতপর যখন তুমি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করে।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
নবুওয়াত লাভের পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কাতে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ করতে থাকেন।
সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিলো তাঁর প্রয়াস। কিন্তু ইসলাম-বিদ্বেষীরা এই শান্তিপূর্ণ প্রয়াসকেও বরদাশত করতে পারেনি। নানা ধরণের বানোয়াট কথা প্রচার করে তারা লোকদের মনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রচারিত দীন সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সত্য সন্ধানী যুবক যুবতীরা এই অপ প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে একে একে ইসলামের পথে এগিয়ে আসে। এতে ইসলাম-বিদ্বেষীরা মারমুখো হয়ে ওঠে এবং মুসলিমদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। মুশরিক নেতাদের বৈরিতার কারণে মাক্কার যমিন মুসলিমদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অনুগ্রহে ইয়াসরিবে ইসলামের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়। অচিরেই ইয়াসরিবে গড়ে ওঠে ইসলামের অনুকূল গণ-ভিত্তি। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি রাষ্ট্র ‘আল মাদীনা আল মুনাওয়ারা। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আলোকে তিনি সমাজের সকল দিক ও বিভাগে আমূল পরিবর্তন সাধনে হাত দেন।
সবেমাত্র একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মাক্কার মুশরিক নেতারা আল মাদীনায় নতুন এক রাষ্ট্র শক্তির বিকাশে শংকিত হয়ে ওঠে। তারা এই রাষ্ট্রশক্তিকে অংকুরেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এক হাজার সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে আল-মাদীনার দিকে অগ্রসর হয়।
মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ নিয়ে আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর প্রান্তরে তাদের মুকাবিলা করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন মুসলিম শহীদ হন। কেউ বন্দী হননি। পক্ষান্তরে মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন যোদ্ধা নিহত হয়। বন্দী হয় ৭০ জন।
এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হিজরী তৃতীয় সনে আল মাদীনার উহুদ প্রান্তরে এসে পৌঁছে মাক্কার তিন হাজার মুশরিক যোদ্ধা। এদের মুকাবিলা করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে উহুদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত যোদ্ধা নিয়ে সরে পড়ে।
মাত্র ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিক বাহিনীর সম্মুখীন হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে জয় লাভ করে। উল্লসিত হয়ে মুজাহিদদের একটি অংশ গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রুমাত পাহাড়ে পাহারায় নিয়োজিত ৫০ জন তীরন্দাজের বেশির ভাগই তাদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করে গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসে। অথচ তাদের প্রতি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ ছিলো ‘কোন অবস্থাতেই স্থান ত্যাগ করা যাবে না।’
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ তখনো মুশরিক। পাহারাদার মুসলিমদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করার বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। একদল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তিনি হঠাৎ মুসলিমদের ওপর চড়াও হন। এই আকস্মিক আক্রমণে মুসলিমগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহত হন। আহত হন শত শত মুজাহিদ।
এই যুদ্ধের পর মুসলিমদেরকে নছীহাত করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এক দীর্ঘ ভাষণ নাযিল করেন। সূরা আলে ইমরানের ১২১ থেকে ২০০ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত এই ভাষণ বিস্তৃত। এই ভাষণের একাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلاَ تَهِنُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَاَنْتُمُ الاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ ০
(আয়াত : ১৩৯)
‘তোমরা মন-ভাংগা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হও।’
যুদ্ধের ময়দানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহীদ হয়েছেন এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে বহুসংখ্যক মুজাহিদ হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তাদের এই ভূমিকার নিন্দা করে এই ভাষণে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
وَمَا مُحَمَّدٌ اِلاَّ رَسُوْلٌ ج قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ ط اَفَاْئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلى اَعْقَابِكُمْ ط وَمَنْ يَّنقَلِبْ عَلى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللّهَ شَيْئًا ط وَسَيَجْزِِى اللّهُ الشّكِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৪)
‘মুহাম্মাদ তো একজন রাসূল বৈ কিছু নয়। তার আগে আরো অনেক রাসূল চলে গেছে। সে যদি মারা যায় তোমরা কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? যেই ব্যক্তি পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শিগগিরই তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’
এই ভাষণের একাংশে অতীতের কিছু আল্লাহ ওয়ালা লোকের যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা অবলম্বনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَكَاَيِّنْ مِّنْ نَّبِىٍّ قتَلَ لا مَعَه رِبِّيُّوْنَ كَثِيرٌ ج فَمَا وَهَنُوْا لِمَا اَصَابَهُمْ فِىْ سَبِيلِ اللّهِ وَمَا ضَعُفُوْا وَمَا اسْتَكَانُوْا ط وَاللّهُ يُحِبُّ الصّبِرِيْنَ০ وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلاَّ اَنْ قَالُوْا ربَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَاِسْرَافَنَا فِىْ اَمْرِنَا وَثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكفِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৬-১৪৭)
‘এর আগে এমন নবী চলে গেছে যার সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লোক লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়ে তারা মনভাংগা হয়নি, দুর্বলতা দেখায়নি এবং বাতিলের সামনে মাথা নত করেনি। এই ধরনের ছবর অবলম্বনকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন। তাদের দু‘আ এই ছিলো-
‘হে আমাদের রব, আমাদের গুনাহ মাফ করে দিন, আমাদের সীমা লংঘন মাফ করে দিন, আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন এবং কাফিরদের মুকাবিলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
অতপর এই ভাষণে উহুদ প্রান্তরে মুমিনদের প্রদর্শিত দুর্বলতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللّهُ وَعْدَهَ اِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ بِاِذْنِه جِ حَتّى اِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِى الاَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِّنْم بَعْدِ مَا اَرـكُمْ مَّا تُحِبُّوْنَ ০
(আয়াত : ১৫২)
‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে সাহায্যের ওয়াদা করেছিলেন তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে তোমরা তাদেরকে হত্যা করছিলে। কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে, তোমাদের কর্তব্য-কর্ম সম্পর্কে মতবিরোধে লিপ্ত হলে এবং যখন আল্লাহ তোমরা যা ভালোবাস (পার্থিব সম্পদ) তা তোমাদেরকে দেখালেন তোমরা নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে।’
এই ভাষণের একাংশে মৃত্যু সম্পর্কে কাফিরদের বিভ্রান্তিকর উক্তিতে প্রভাবিত না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَقَالُوْا لاِخْوَانِهِمْ اِذَا ضَرَبُوْا فِى الاَرْضِ اَوْ كَانُوْا غُزًّى لَّوْ كَانُوْا عِنْدَنَا مَا مَاتُوْا وَمَا قُتِلُوْا ج لِيَجْعَلَ اللّهُ ذلِكَ حَسْرَةً فِى قُلُوْبِهِمْ ط وَاللّهُ يُحْى وَيُمِيتُ ط وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ০ وَلَئِن قُتِلْتُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللّهِ اَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ ০
(আয়াত : ১৫৬-১৫৭)
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কাফিরদের মতো কথা বলো না। তাদের আত্মীয়দের কেউ সফরে বের হলে কিংবা যুদ্ধে অংশ নিলে (কোন দুর্ঘটনা আপতিত হলে) বলে, ওরা যদি আমাদের কাছে থাকতো, তাহলে মারা পড়তো না কিংবা নিহত হতো না। তাদের কথাকে আল্লাহ তাদের মনের খেদ ও আক্ষেপের কারণ বানিয়ে দেন। অথচ আল্লাহই জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ দেখেন। তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মারা যাও, অবশ্যই তোমরা আল্লাহর মাগরিফাত ও রাহমাত পাবে যা উত্তম ওরা যা কিছু জমা করছে তা থেকে।’
অতপর আলোচ্য আয়াতে (১৫৯ নাম্বার আয়াতে) এসে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন এবং সর্বাবস্থায় তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ প্রদান করেন।
৪। ব্যাখ্যা
আলোচ্য আয়াতের শুরুতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ .
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি বিনম্র হয়েছো।’
لِيْنٌ অর্থ নম্রতা, কোমলতা। لِنْتَ শব্দটি لِيْنٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
এই আয়াতাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নম্র বা কোমল আচরণকে সপ্রশংস ভংগিতে প্রকাশ করেছেন। এটাও তিনি উল্লেখ করেছেন যে আল্লাহর অনুগ্রহেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটি করতে পেরেছেন। তার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর অনুগ্রহ সিক্ত বা অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই অনুগামীদের প্রতি নম্র বা কোমল আচরণ করা সম্ভব।
অনুগামীদের প্রতি নম্র আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন সূরা আশ্ শূ‘আরা-র ২১৫ নাম্বার আয়াতে বলেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُوْمِنِيْنَ .
‘তোমার অনুগামী মুমিনদের প্রতি তোমার ডানা নুইয়ে দাও।’ অর্থাৎ তাদের সাথে নম্র আচরণ কর।
নম্র আচরণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِى الاَمْرِ كُلِّهِ .
(আয়িশা (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি সকল কাজেই কোমলতা পছন্দ করেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ اَوْحى اِلَىَّ اَنْ تَوَاضَعُوْا حَتّى لاَ يَفْخَرَ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ.
(ইয়াদ ইবনুল হিমার (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘আল্লাহ আমার নিকট ওয়াহী পাঠিয়েছেন যে তোমরা পরস্পর নম্র আচরণ কর, কেউ কারো ওপর গৌরব করো না, কেউ কারো ওপর বাড়াবাড়ি করো না।’
تَوَاضُعٌ অর্থ বিনয়, নম্রতা। تَوَاضَعُوْا শব্দটি تَوَاضُعٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِّنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِِعَفْوٍ اِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ اَحَدٌ لِلّهِ اِلاَّ رَفَعَهُ اللّـهُ .
(আবু হুরাইরা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘দান দ্বারা সম্পদ কমে না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ বান্দার ইযযাত বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনম্র আচরণ করলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اَلاَ اَخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَّحْرُمُ عَلَى النَّارِ اَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ تَحْرُمُ عَلى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لََيِّنٍ سَهْلٍ .
(আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা), জামে আততিরমিযী।)
‘আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করবো না কোন্ ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম অথবা কার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম। জাহান্নামের আগুন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য হারাম যে লোকদের সান্নিধ্যে থাকে, যে কোমলমতি, বিনম্র ও নরম মেজাজের অধিকারী।’
একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নছীহাত করতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ فَِايَّكَ اَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ .
(আয়িয ইবনু আমর (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘অবশ্যই নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তিরা যারা অনুগামীদের প্রতি কঠোর। সাবধান, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّمَا الاِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ َيُتَّقَى بِهِ فَاِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَ عَدَلَ كَانَ لَهُ بِذلِكَ أَجْرٌ وَاِنْ يَأمُرُ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ .
(আবু হুরাইরা (রা,) ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা ঢালের মতো। তার অধীনে থেকে লড়াই করা হয়। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সে যদি তার অনুগামীদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয় এবং তাদের মাঝে আদল প্রতিষ্ঠা করে তাহলে সে পুরস্কার পাবে, যদি এর বিপরীত কাজ করে তাহলে পাবে শাস্তি।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর আদালতে নেতৃত্বের জওয়াবদিহি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বলেন,
اَلاِمَامُ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَّعِيَّتِهِ .
(আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা একজন তত্ত্বাবধায়ক। তাকে তার নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধান সম্পর্কে জওয়াবদিহি করতে হবে।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَامِنْ اَمِيْرِ عَشَرَةٍ يُؤْتَى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَغْلُولاً حَتَّى يُفَكَّ عَنْهُ الْعَدْلُ اَوْ يُوْبِقَهُ الْجُوْرِ.
(আবু হুরাইরা (রা), সুনানু আদ্ দারেমী।)
‘কোন ব্যক্তি যদি দশজন লোকেরও নেতা হয়, কিয়ামাতের দিন তাকে বেড়ি লাগানো অবস্থায় হাজির করা হবে। (লোকদের পরিচালনাকালে) তার অনুসৃত ন্যায়নিষ্ঠতা এই অবস্থা থেকে তার মুক্তির কারণ হবে অথবা তার কৃত অন্যায় তার ধ্বংসের কারণ হবে।’
অতপর আলোচ্য আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ .
‘তুমি যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে লোকেরা তোমার চার দিক থেকে সরে যেতো।’
নম্র আচরণ মানুষকে আকর্ষণ করে। পক্ষান্তরে রূঢ় আচরণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বস্ত্তত রুক্ষভাষা বা রূঢ় আচরণের উৎস হচ্ছে কঠোর চিত্ত।
এখানে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কঠোর চিত্ততা ও রুক্ষভাষার পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
নেতৃত্ব বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি কঠোর চিত্ত ও রুক্ষভাষী হন, অনুগামীগণ তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারা পারত পক্ষে তাঁর নিকটে ঘেঁষতে চায় না।
ইসলামী সংগঠনে, ইসলামী সমাজে এমন পরিবেশ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত।
এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاعْفُ عَنْهُمْ .
‘তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
اَلْعَفْوَ বা ক্ষমাশীলতা অতি উচ্চমানের একটি গুণ। আল্লাহ চান, নেতৃত্বের আসনে আসীন প্রত্যেক ব্যক্তি এই গুণে গুণান্বিত হোক।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর অনুগামীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপ নির্দেশ আমরা দেখতে পাই সূরা আল আ‘রাফের ১৯৯ নাম্বার আয়াতে। আল্লাহ বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَاْمُرْ بِالْعُرْفِ وَاعَرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ .
‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, মা‘রূফ কাজের নির্দেশ দাও’ এবং জাহিলদেরকে এড়িয়ে চল।’
সূরা আল হিজরের ৮৫ নাম্বার আয়াতে তিনি বলেন,
فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيْلَ .
‘অতএব তুমি অতি সুন্দরভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
যদিও এইসব আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করা হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে ইসলামী সমাজের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্যই এই নির্দেশ।
যিনি মহান আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
اَللّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ .
(হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাকারী। আপনি ক্ষমা ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।)
তিনি তাঁর অনুগামী বা সহকর্মীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করবেন না, তা তো হতে পারে না।
এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ .
‘এবং তাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
اَلاِسْتِغْفَارُ অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা।
এটিও মুমিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
সূরা মুহাম্মাদ-এর ১৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ .
‘এবং তুমি তোমার নিজের এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
ইসতিগফার-এর কল্যাণময়তা বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنَ كُلِّ ضِيْقٍ مَخْرَجًا وَّ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَّ رَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ .
(আবদুল্লাহ ইবনুল আববাস (রা), সুনানু আবী দাউদ।)
‘যেই ব্যক্তি সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে আল্লাহ তাকে প্রতিটি সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ করে দেন, প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেন এবং তার ধারণার অতীত উৎস থেকে তাকে রিযক দেন।’
অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করার ফযিলত সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لاَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مَسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لاَخِيْهِ بِخَيْرٍٍ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ امِيْنَ وَلَكَ بِمِثْلٍ .
(আবু দারদা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘ভাইয়ের অসাক্ষাতে কোন মুসলিম ব্যক্তির দু‘আ তার জন্য কবুল হয়। তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন এ ব্যক্তি তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দু‘আ করে তখন ঐ ফেরেশতা বলে, ‘আমীন, তোমার জন্যও অনুরূপ।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
خِيَارُ اَئِمَّتِِكُمُ الَّذِيْنَ تُحِبُّوْنَهُمْ وَيُحِبُّوْنَكُمْ وَتُصَلُّوْنَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّوْنَ عَلَيْكُمْ وَشِرَارُ اَئِمَّتِكُمُ الَّذِيْنَ تُبْغِضُوْنَهُمْ وَ يُبْغِضُوْنَكُمْ وَتَلْعَنُوْنهُمْ وَيَلْعَنُوْنَكُمْ .
(আওফ ইবনু মালিক (রা), ছাহীহ মুসলিম।)
‘তোমাদের উত্তম নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস, তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দু‘আ কর, তারাও তোমাদের জন্য দু‘আ করে।
তোমাদের মন্দ নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর, তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও, আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।’
ইসতিগফার-এর ফযিলত বুঝাতে গিয়ে সূরা আল আনফালের ৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ .
‘এটা আল্লাহর নিয়ম নয় যে লোকেরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’
আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَشَاوِرْ هُمْ فِى الاَمْرُ .
‘এবং তাদের সাথে সামষ্টিক বিষয়ে পরামর্শ কর।’
اَلشُّوْرى অর্থ পরামর্শ।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসকালানী (রহ) বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করা শারীয়ার অন্যতম বিধান।’
আল হাসান ইবনু আবিল হাসান (রহ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, যেই জনগোষ্ঠী পরামর্শ করে কাজ করে তারা সর্বোত্তম পন্থার সন্ধান পেয়ে যায়।’
নবুওয়াতের পঞ্চম সনে নাযিলকৃত সূরা আশ্ শূরার ৩৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে الشُوْرى শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন,
وَاَمْرُهُمْ شُوْرى بَيْنَهُمْ .
‘তাদের সামষ্টিক বিষয় পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়।’
আর এই আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামষ্টিক বিষয়ে অনুগামীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি খুবই সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তথাপিও তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নভাবে তাঁর সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করতেন।
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর চেয়ে বেশি পরামর্শ করতে আর কাউকে দেখিনি।’
(জামে আত্ তিরমিযী, ৩য় খন্ড, হাদীস নাম্বার ১৬৫৯)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি রাতে ছালাতুল ইশার পর আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) ও উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে পরামর্শ করতেন।
আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তিনি ‘আশইয়াখে বাদরিন’ (বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ছাহাবী)দেরকে ডাকতেন এবং তাঁদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি যোদ্ধাদেরকে মাসজিদে নববীতে সমবেত করে যুদ্ধস্থল নির্ধারণ বিষয়ে পরামর্শ করেন।
পরামর্শ সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম কথা হচ্ছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত চেয়ারের পক্ষ থেকে রুলিং দেওয়া না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ একটি অভিমত, সিদ্ধান্ত নয়।
অভিমতের পক্ষে রুলিং দিলে তবেই তা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়।
অতপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ ط
‘যখন তুমি সংকল্প গ্রহণ কর বা সিদ্ধান্তে উপনীত হও, তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর।’
عَزْمَةٌ অর্থ সংকল্প, সিদ্ধান্ত, করণীয় সম্পর্কে মনস্থির করে ফেলা।
নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে হতে হবে প্রশস্ত চিত্ত। অর্থাৎ তাকে উদার চিত্তে যতো বেশি সম্ভব লোকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
আবার, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্বকে হতে হবে দৃঢ় চিত্ত।
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর মন পুরোপুরি দোদুল্যমানতা মুক্ত করতে হবে।
একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে পরিপূর্ণ মানসিক বলিষ্ঠতা সহকারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে।
আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।’
সূরা ইবরাহীম এর ১১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘এবং আল্লাহর ওপরই মুমিনদের তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
সুলা আল ফুরকান-এর ৫৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَتَوَكَّلْ عَلىَ الْحَىِّ الَّذِىْ لاَ يَمُوْتُ .
‘সেই চিরঞ্জীব আল্লাহর ওপরই তাওয়াককুল কর যিনি মরেন না।’
সূরা আত্ তালাক-এর ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ .
‘যেই ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট।’
تَوَكُّلْ অর্থ ভরসা, নির্ভরতা, নির্ভরশীলতা।
ইকামাতুদ্ দীনের জন্য মুমিনদেরকে যতো বেশি সম্ভব মানবসম্পদ এবং বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে। কিন্তু মুমিনদেরকে ইয়াকীন রাখতে হবে যে বিজয়ের চাবিকাঠি সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের হাতে।
এই কথাটি মুমিনদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করার জন্য আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنْ يَّنْصُرْكُمُ اللّـهُ فَلاَ غَالِبَ لِكُمْ ج وَاِنْ يَّخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَالَّذِىْ يَنْصُرُكُمْ مِّنْ مبَعْدِه ط وَ عَلىَ اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সাহায্য করেন, এমন কোন শক্তি নেই তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। আর তিনি যদি তোমাদেরকে পরিত্যাগ করেন, আর কে আছে তোমাদেরকে সাহায্য করার মতো! এবং মুমিনদের তো আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
অন্যত্র আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا النَّصْرُ اِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ . (আলে ইমরান ১২৬)
‘বিজ্ঞতাময় মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিকট থেকে ছাড়া অন্য কোথাও থেকে বিজয় আসে না।’
৫। শিক্ষা
১। অনুগামীদের ব্যাপারে কঠোর চিত্ততা পরিহার করতে হবে।
২। অনুগামীদের প্রতি রুক্ষভাষী হওয়া যাবে না।
৩। অনুগামীদের সাথে নম্র আচরণ করতে হবে।
৪। অনুগামীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করতে হবে।
৫। অনুগামীদের জন্য সর্বদা মাগফিরাতের দু‘আ করতে হবে।
৬। অনুগামীদের সাথে পরামর্শ আদান-প্রদান করতে হবে।
৭। পরামর্শের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হলে দৃঢ় চিত্ততা নিয়ে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮। যতো বেশি সম্ভব মানব সম্পদ ও বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে, কিন্তু তাওয়াক্কুল করতে হবে একমাত্র আল্লাহর ওপর। কেননা সাহায্য ও বিজয় একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই এসে থাকে।
চমৎকার৷ তবে প্রথমে একটা ভূল তথ্য চলে আসছে৷ ওহুদ যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০জন তীরন্দাজ সাহাবীকে গিরিপথে রেখেছিলেন, বদর যুদ্ধে নয়৷
ReplyDeleteএখানে উহুদের কথাই বলা হয়েছে। জাজাকাল্লাহু।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআর বদর যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তিনশত সৈন্য নিয়ে পালিয়েছিলো ওহুদে নয়৷ প্লিজ রেক্টিফাই ইট৷
ReplyDeleteঐতিহাসিক তথ্য মতে উহুদেই ৩০০ জন্য সরে পড়েছিল।
Delete