اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّه لَيَحْزُنُكَ الَّذِىْ يَقُوْلُوْنَ فَاِِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০ وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوْا عَلٰى مَا كُذِّبُوْا وَاُوذُوْا حَتّٰى اَتـهُمْ نَصْرُنَاۚۚ وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِۚۚ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ০ وَاِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ اِعْرَاضُهُمْ فَاِنِ اسْتَطَعْتَ اَنْ تَبْتَغِىَ نَفَقًا فِى الْأَرْضِ اَوْ سُلَّمًا فِى السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِايَةٍ ط وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجهِلِيْنَ ০ اِنَّمَا يَسْتَجِيْبُ الَّذِيْنَ يَسْمَعُوْنَ ط وَالْمَوْتٰى يَبْعَثُهُمُ اللهُ ثُمَّ الَيْهِ يُرْجَعُوْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
৩৩. ‘আমি অবশ্যই জানি তারা যেইসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তা তোমাকে মানসিকভাবে দারুণ কষ্ট দেয়, কিন্তু তারা তো আসলে তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করছে না, বরং এই যালিমরা আল্লাহর আয়াতগুলোকেই অস্বীকার করছে।
৩৪. এবং তোমার পূর্বে বহু রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু এই মিথ্যা আরোপ করে তাদেরকে যেই কষ্ট দেওয়া হয়েছে এর মুকাবিলায় তারা ছবর অবলম্বন করেছে, যেই পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছে। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে পারে এমন কেউ নেই। আর পূর্বেকার রাসূলদের কথা তো তোমার নিকট পৌঁছেছে।
৩৫. এবং তাদের এই উপেক্ষা যদি তোমার কাছে অসহনীয় হয়, তাহলে সাধ্য থাকলে তুমি মাটির গভীরে কোন সুড়ংগ খোঁজ কিংবা আসমানের দিকে সিঁড়ি লাগাও এবং তাদের জন্য কোন নিদর্শন নিয়ে আস। আল্লাহ যদি চাইতেন যে তিনি সকলকে হিদায়াতের ওপর একত্রিত করবেনই, তা তো তিনি করতেই পারতেন। অতএব তুমি জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
৩৬. আহবানে তো তারাই সাড়া দেয়, যারা শুনতে পায়। আর মৃতদেরকে আল্লাহ পুনর্জীবিত করবেন এবং তারা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে।
৩। পরিপ্রেক্ষিত
নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৪০ বছর মাক্কায় বসবাস করেন। তাঁর বিশ্বস্ততা ও আমানাতদারীতে মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ‘আলআমীন’ বলে ডাকতো। অপর দিকে তিনি ছিলেন সত্যবাদিতার বিমূর্ত রূপ। জীবনে তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন নি। তাঁর সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ডাকতো ‘আছ ছাদিক’ বলে। তিনি ছিলেন সকলেরই প্রিয়জন।
নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরবে ‘আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ’-র কাজ করছিলেন। তিন বছর পর আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের নির্দেশেই সরবে দা‘ওয়াত প্রদানের কাজ শুরু করেন।
অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
জাহিলিয়াতে আকষ্ঠ নিমজ্জিত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে।
বেশ কিছু সত্য-সন্ধানী ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। ইসলাম বিদ্বেষীরা এই নব গঠিত শক্তিকে ‘অংকুরে বিনাশ করতে চায়। সমাজ অংগনে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে।
ইসলাম বিদ্বেষীরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার ঝড় সৃষ্টি করে। পাশাপাশি তারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর যুলম-নির্যাতন চালাতে থাকে।
ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা প্রচারণার কতগুলো কথা ছিলো নিম্নরূপঃ
০ মুহাম্মাদ একজন গণক।
০ মুহাম্মাদ একজন পাগল।
০ মুহাম্মাদ একজন কবি।
০ মুহাম্মাদ একজন যাদুকর।
০ মুহাম্মাদ নিজেই কালাম রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
০ মুহাম্মাদ তো একজন মানুষ। মানুষ নবী হবে কেন?
০ মুহাম্মাদ নবী হলে তো তার সাথে বিশাল ধন ভান্ডার এবং ফেরেশতাদের একটি বাহিনী থাকতো।
০ মুহাম্মাদ আল্লাহর কালাম বলে যা পেশ করছে সেই গুলো অতীতকালের কিস্সা কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে তিনজন কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস, আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জিবয়ারী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাব মর্যাদা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে বানোয়াট কথা সম্বলিত কবিতা রচনা করে জন সমক্ষে আবৃত্তি করে বেড়াতো।
ইসলাম-বিদ্বেষীদের হাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৈহিকভাবেও নিপীড়িত হন।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুলন্দ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’। ইসলামের দুশমনেরা চারদিক থেকে ছুটে এসে তার ওপর হামলে পড়ে। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন হারিস ইবনু আবি হালাহ (রা)। এক দুশমনের তলোয়ারের আঘাতে হারিস (রা) নিহত হন। তিনিই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীদের মধ্যে প্রথম শহীদ।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে মুসলিমগণ একটি জনসভার আয়োজন করেন। বক্তা হিসেবে নিদিষ্টি ছিলেন আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা)। বক্তৃতা শুরু করার সাথে সাথেই ইসলামের দুশমনেরা হামলা চালায়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)সহ অনেকেই আহত হন। লাঠির আঘাতে আহত আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) গভীর রাত পর্যন্ত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কালে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গলায় একখন্ড কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করে। আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) দৌঁড়িয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন।
০ একদিন পথিমধ্যে আবু জাহল বেশ কিছু ধূলাবালি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘ওহে লোক সকল, তোমরা এর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করো না। এ চায় তোমরা লাত ও উয্যার উপাসনা ছেড়ে দাও।’
০ একদিন কা‘বার চত্বরে ছালাত আদায় কালে সাজদায় গেলে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাঁধে, পিঠে, মাথায় একটি উটের নাড়িভুড়ি তুলে দেয়।
০ আবু লাহাব ও উকবা ছিলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিবেশী। তারা তাদের বাড়ির আবর্জনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের সামনে ছুঁড়ে মারতো।
০ ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রান্নাঘরে ঢুকে হাড়ি পাতিলের ভেতর উটের নাড়িভুড়ি রেখে আসতো।
০ ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরওয়াজায় কাঁটা পুঁতে ও ছড়িয়ে রাখতো।
০ একদিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা‘বার নিকটে বসা ছিলেন। দুর্বৃত্ত উকবা সেখানে এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করে।
০ নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সন থেকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর অনুসারীগণ এবং বানু হাশিমের সদস্যগণ শিয়াবে আবু তালিবে তিনটি বছর কষ্টকর অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেন।
০ নবুওয়াতের নবম সনে ‘আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ’র কাজ করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তায়েফ পৌঁছেন। সেখানকার তিন সরদার আবদ ইয়ালিল ইবনু আমর, মাসউদ ইবনু আমর ও হাবীব ইবনু আমর তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে। তারা তাঁর পেছনে একদল গুন্ডাকে লেলিয়ে দেয়। দুর্বৃত্তরা পাথর খন্ড নিক্ষেপ করে করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। ক্লান্ত ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি কয়েকবার রাস্তার ওপর পড়ে যান। এইভাবে দুই তিন মাইল পথ চলেন। এই সময় কয়েকজন প্রবীণ লোক এগিয়ে এসে তাঁকে শহরের বাইরে পৌঁছে দিয়ে যায়। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি একটি আংগুরের বাগানে ঢুকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়েন। অশ্রুভরা চোখে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাতে থাকেন।
০ তায়েফ থেকে মক্কার পথ ধরে এগুচ্ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পথিমধ্যে তিনি খবর পান যে মুশরিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁকে আর মাক্কায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এ ছিলো যেন নাগরিকত্ব বাতিলের ঘোষণা।
এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখনাস ইবনু শুরাইকের সহযোগিতা চান। আখনাস রাজি হলেন না। এবার তিনি সুহাইল ইবনু আমরের সহযোগিতা চান। সুহাইল রাজি হলেন না। অতপর তিনি মুতয়িম ইবনু আদীর সহযোগিতা চান। মুতয়িম রাজি হন এবং তাঁর ছেলেরা সহ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কায় এনে কা‘বার চত্বরে পৌঁছে দেন। কা‘বার তাওয়াফ করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন ঘরে ফেরেন।
উল্লেখ্য যে এই কয়টি বছরে ইসলাম বিদ্বেষীদের হামলা ও নির্যাতনে প্রাণ হারান কয়েকজন মুসলিম। আহতদের সংখ্যা ছিলো আরো বেশি। অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে শতাধিক মুসলিম হাবশায় হিজরাত করেন।
পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে মাক্কা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের ইসলাম গ্রহণের হার কমে যায়।
সামগ্রিকভাবে জনগোষ্ঠীর অবস্থান ছিলো ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে। নিদারুণ মানসিক কষ্ট অনুভব করছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
এই প্রেক্ষাপটে, মাক্কী জীবনের শেষভাগে, অবতীর্ণ হয় সূরা আল আন‘আম। পুরো সূরাটি একই সংগে অবতীর্ণ হয়।
৪। ব্যাখ্যা
৩৩ নাম্বার আয়াত
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّه لَيَحْزُنُكَ الَّذِىْ يَقُوْلُوْنَ فَاِِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০
قَدْ نَعْلَمُ আয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীরা যেই সব কথা এবং যেইসব কাজ করে নবীকে কষ্ট দিচ্ছে সেই সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। বস্ত্ততঃ বিশ্বজাহানের কোন কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে, আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে, থাকতে পারে না।
لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ আয়াতাংশ দ্বারা তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তারা অস্বীকার করছে না। বরং ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তো তারা ‘আলআমীন ও ‘আছ-ছাদিক’ বলে ডেকে তৃপ্তিবোধ করতো। মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলে মেনে নিতেই ছিলো তাদের আপত্তি।
وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০
আয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরোধিতার আসল লক্ষ্য বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর আয়াতসমূহ, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান।
আল্লাহর আয়াতসমূহ তাদের চক্ষুশূল। আল্লাহর বিধান তাদের বড্ড অপছন্দনীয়। এই বিধান যাতে সমাজ-সভ্যতার অংগনে শিকড় গাড়তে না পারে সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত ছিলো তাদের সকল তৎপরতা।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অবতীর্ণ আয়াতসমূহের, তার অবতীর্ণ বিধানের, বিরোধিতা করা মস্ত বড়ো যুলম, মস্ত বড়ো অন্যায়। এই যালিমরা সেই অন্যায় কাজেই লিপ্ত রয়েছে।
৩৪ নাম্বার আয়াত
وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوْا عَلٰى مَا كُذِّبُوْا وَاُوذُوْا حَتّٰى اَتـهُمْ نَصْرُنَا ج وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِ ج وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে অতীত কালেও ইসলাম অস্বীকারকারীগণ বহু নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে এবং তাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আরো জানাচ্ছেন যে সেই নবীগণ নানা ধরনের কষ্টের সম্মুখীন হয়েও ছবর অবলম্বন করেছেন, কর্তব্য পালনে দৃঢ়পদ থেকেছেন, আপোসহীন ভাবে সত্যের উদ্ভাসনের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁরা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সাহায্য লাভ করেছেন।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন, وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِ ج
অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের যেই বিধান আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নির্ধারিত করেছেন তা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এই বিধান চিরদিন অপরিবর্তিত থাকবে।
এই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন, وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ
অর্থাৎ অতীতকালে বিভিন্ন নবী কর্তৃক ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনা এবং তাদের প্রতি ইসলাম বিদ্বেষীদের আচরণের কথা তো তোমাকে জানানো হয়েছে। ইসলাম-বিদ্বেষীগণ কর্তৃক ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো এবং নানাভাবে তাদেরকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টি কোন নতুন বিষয় নয়।
উল্লেখ্য যে নূহ (আলাইহিস সালাম), ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), হুদ (আলাইহিস সালাম), ছালিহ (আলাইহিস সালাম), শুয়াইব (আলাইহিস সালাম), মূসা (আলাইহিস সালাম), ঈসা (আলাইহিস সালাম) প্রমুখ একই রূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন।
৩৫ নাম্বার আয়াত
وَاِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ اِعْرَاضُهُمْ فَاِنِ اسْتَطَعْتَ اَنْ تَبْتَغِىَ نَفَقًا فِى الْأَرْضِ اَوْ سُلَّمًا فِى السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآيَةٍ ط وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجهِلِيْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে এই ইংগিত রয়েছে যে কোন কোন সময় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনের গভীরে এই ধরনের বাসনা জন্ম নিতো যে ‘আহ্, যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোন নিদর্শন প্রকাশিত হতো যা দেখে ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারীরা দা‘ওয়াত কবুল করতে বাধ্য হতো।’
এই প্রসংগেই আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন যে ইসলাম বিদ্বেষীদের দা‘ওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতিতে তুমি যদি ছবর অবলম্বন করতে না পার, তবে মাটির গভীরে সুড়ংগ করে কিংবা আসমানে সিঁড়ি লাগিয়ে কোন নিদর্শন এনে অলৌকিকভাবে কিছু ঘটাবার চেষ্টা কর। কিন্তু ভেবো না আমি তোমার এই ধরনের বাসনা পূর্ণ করবো। কারণ আমার পরিকল্পনায় এই ধরনের নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারিত নেই।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন যে যদি কোন না কোনভাবে সকল মানুষকে আল্লাহর বিধানের অনুসারী বানানোই লক্ষ্য হতো তাহলে কিতাব নাযিল করা, মুমিনদেরকে ইসলাম বিদ্বেষীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং মানযিলের পর মানযিল ইসলামী আন্দোলনকে পথ চলতে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিলো! আল্লাহর একটি ইশারাই তো এই কাজের জন্য যথেষ্ট হতো। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এই পদ্ধতিতে মানুষকে ইসলামের অনুসারী বানাতে চান না। এটাকে তিনি বিজ্ঞতাপূর্ণ কাজ মনে করেন না।
তিনি চান ইসলামকে বিজ্ঞতাসহকারে মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে এবং মানুষকে তাদের আকল ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে সত্যের পথে এগিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হবে।
৩৬ নাম্বার আয়াত
اِنَّمَا يَسْتَجِيْبُ الَّذِيْنَ يَسْمَعُوْنَ ط وَالْمَوْتٰى يَبْعَثُهُمُ اللهُ ثُمَّ الَيْهِ يُرْجَعُوْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এই মহাসত্যটি তুলে ধরেছেন যে, ‘যারা শুনে তারাই তো দা‘ওয়াত কবুল করে।’ ‘যারা শুনে’ বলে এখানে ওই ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা বিবেককে জাগ্রত রাখে, যারা মনের দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে দেয় না।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে ‘মৃত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরকে যারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলে, অন্ধের মতো সামনের দিকে এগিয়ে যায়, অন্য কোন পথ আছে কিনা তা ভেবেও দেখে না।
৫। শিক্ষা
(1) আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন হক ও বাতিলের কিংবা ইসলাম ও জাহিলিয়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের যেই বিধান নির্ধারিত করেছেন, তা কখনো পরিবর্তিত হবে না।
(2) ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদেরকে অবশ্যই দীর্ঘকাল পরীক্ষার আগুনে পোড় খেতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিথ্যা প্রচারণা এবং তাদের ওপর চাপানো যুলম নির্যাতনকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যে যারা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সামনে এগুতে বদ্ধপরিকর, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাদেরকে পথ প্রদর্শন করেন এবং এই পথে চলতে চলতে তারা তাদের জীবনে উৎকৃষ্ট গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে যেই ধরনের সাহায্য লাভের উপযুক্ত বলে প্রমাণ পেশ করেন, আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদেরকে সেই ধরনের সাহায্যও দিয়ে থাকেন।
(3) সর্বাবস্থায় দৃঢ়তা অবলম্বন করে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
--০--
এ.কে.এম. নাজির আহমদ
No comments:
Post a Comment