Thursday, August 3, 2023

সব দেশে কি নবী এসেছেন?

পৃথিবীতে মহান আল্লাহর রীতি হলো তিনি প্রতিটি যুগে, প্রত্যেক জাতির জন্য সতর্ককারী পাঠিয়েছেন। কখনো কখনো সতর্ককারী নবী হিসেবে আগমন করেছেন। কখনো রাসুল হিসেবে আগমন করেছেন। কখনো দাঈ বা ধর্মপ্রচারক হিসেবে আগমন করেছেন। যিনি দাঈ বা ধর্মপ্রচারক, তাঁর জন্য নবী হওয়া জরুরি নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি দৌড়ে এলো। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা রাসুলদের অনুসরণ করো। ’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ২০)

উল্লিখিত ব্যক্তি নবী বা রাসুল ছিলেন না, কিন্তু ধর্মপ্রচারক ছিলেন। লোকমান (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। বিশুদ্ধ অভিমত হলো, তিনি নবী ছিলেন না; কিন্তু তিনি তাঁর ছেলেকে তাওহিদের শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন লোকমান উপদেশ হিসেবে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা অন্যায়। ’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৩)। সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মহান আল্লাহ প্রতিটি জাতির উদ্দেশে পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে কয়েকটি আয়াত এসেছে।

(১) ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো...। ’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৩৬)

এ আয়াত থেকে জানা যায়, আল্লাহ ইবাদত করার ও তাগুত (খোদাদ্রোহী শক্তি) বর্জনের নির্দেশ দিয়ে প্রত্যেক জাতির জন্য ‘রাসুল’ পাঠানো হয়েছে। (২) ‘তোমার পালনকর্তা জনপদগুলো ধ্বংসকারী নন, যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে রাসুল প্রেরণ না করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং আমি জনপদসমূহকে তখনই ধ্বংস করি, যখন তার বাসিন্দারা জুলুম করে। ’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৫৯)

উল্লিখিত আয়াত থেকে জানা যায়, ‘সব জাতির জন্য রাসুল পাঠানো হয়েছে’—কথাটির অর্থ হলো, সব জনপদের কেন্দ্রস্থলে নবী পাঠানো হয়েছে। (৩) ‘আমি তোমার আগে অনেক রাসুল প্রেরণ করেছি, তাদের কারো কারো ঘটনা তোমার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারো কারো ঘটনা তোমার কাছে বিবৃত করিনি...। ’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ৭৮)। এ আয়াত থেকে জানা যায়, অনেক নবী-রাসুল এমন রয়েছেন, যাঁদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।

(৪) ‘আমি তোমাকে সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোনো জাতি নেই, যার মধ্যে সতর্ককারী আসেনি। ’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৪)। এ আয়াতে নবী-রাসুল শব্দের পরিবর্তে সংবাদদাতা-সতর্ককারী তথা আল্লাহর প্রতিনিধি পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।

(৫) কাফিররা বলে, ‘তার প্রতি তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয়নি কেন?’ ‘(আল্লাহ বলেন) তোমার কাজ তো (আজাবের ব্যাপারে) ভয় প্রদর্শন করা। আর প্রত্যেক জাতির জন্য পথপ্রদর্শক রয়েছে। ’ (সুরা রাদ, আয়াত : ৭)

এই আয়াত থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে সব জাতির জন্য নবী বা রাসুল পাঠানোর কথার মূল উদ্দেশ্য

হলো, সব জাতির জন্য ‘পথপ্রদর্শক’ পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে কি নবী এসেছেন?

পবিত্র কোরআনের উল্লিখিত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা বিশুদ্ধ উৎস থেকে না জেনে কোনো কোনো ভাই প্রশ্ন তোলেন যে বাংলাদেশে, ভারতবর্ষে, চীনে, আমেরিকায় ও আফ্রিকায় কি কোনো নবী এসেছে? কেউ কেউ তো বলে বেড়ান যে ‘কোরআনে ভুল আছে! (নাউজুবিল্লাহ) কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, সব জাতির জন্য নবী এসেছে। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য তো কোনো নবী আসেনি!’ এগুলো হঠকারিতামূলক প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন চরম অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। প্রথম কথা হলো, এ বিষয়ে বর্ণিত আয়াতগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 

এক. রাসুল। দুই. হাদি বা পথপ্রদর্শক। তিন. বাশির ও নাজির বা সুসংবাদবাহী ও সতর্ককারী। এ আয়াতগুলোর সামষ্টিক বর্ণনা থেকে যদি এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে সব জাতির জন্য হাদি বা আল্লাহর পথে পথনির্দেশকারী পাঠানো হয়েছে, তাহলে আর এ প্রশ্ন আসে না যে আমেরিকায়, চীনে, ভারতবর্ষে ও বাংলাদেশে কেন নবী আসেনি? কেননা এসব দেশেও আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দাঈরা দ্বিন ও শরিয়ত প্রচার করেছেন। কিন্তু হ্যাঁ, যদি এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে সব দেশে আল্লাহর রাসুল এসেছেন, তাহলেই শুধু এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে আমেরিকায়, চীনে, ভারতবর্ষে ও বাংলাদেশে কেন নবী আসেনি? 

এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে ‘রাসুল’ শব্দের অর্থ জানা প্রয়োজন। ‘রাসুল’ শব্দের অর্থ প্রতিনিধি। পরিভাষায় আসমানি গ্রন্থ ও বিশেষ বিধান নিয়ে আসা নবীদের ‘রাসুল’ বলা হয়। শাব্দিক অর্থের দিকে তাকিয়ে পবিত্র কোরআনে নবীদের পাশাপাশি কোনো কোনো ফেরেশতার জন্য ‘রাসুল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসুলের (বহন করা/ বাহিত) বার্তা। ’ (সুরা হাক্বকাহ, আয়াত : ৪০)

সর্বসম্মতিক্রমে এ আয়াতে রাসুল মানে জিবরিল (আ.)। সুতরাং সব জাতির জন্য নবী বা প্রতিনিধি প্রেরণ বিষয়ে বর্ণিত আয়াতগুলোতে ‘রাসুল’ শব্দ যদি নবীদের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে আয়াতের অর্থ হলো, ইবাদতের আদেশপ্রাপ্ত প্রধান দুই জাতি তথা মানুষ ও জিন জাতির কাছে আল্লাহর নবী পাঠানো হয়েছে। সে হিসাবে মানুষ একটি জাতি। জিন একটি জাতি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(কিয়ামতের দিন বলা হবে) হে জিন ও মানবজাতি, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলরা আসেনি, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াত বর্ণনা করত এবং তোমাদের আজকের এই দিনের মুখোমুখি হওয়া সম্পর্কে সতর্ক করত? তারা বলবে, আমরা নিজ অপরাধ স্বীকার করে নিলাম। আসলে পার্থিবজীবন তাদের প্রতারিত করেছে। আর তারা নিজেদের বিরুদ্ধে এ সাক্ষ্যও দেবে যে তারা কাফির ছিল। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৩০)

এ আয়াত থেকে জানা যায়, মানবজাতির উদ্দেশে নবী হিসেবে যেমন মহামানব প্রেরিত হয়েছে, তেমনি জিন জাতির উদ্দেশে নবী হিসেবে জিন প্রেরিত হয়েছে। তবে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি গোটা বিশ্বের মানব ও জিন জাতির রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে এসব আয়াতে যদি ‘রাসুল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে আয়াতের মূল অর্থ হলো—প্রত্যেক জাতির জন্য মহান আল্লাহর বাণী প্রচারক ও সতর্ককারী পাঠানো হয়েছে। এই অর্থে বলা যায়, মানবজাতির মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত সব জাতিসত্তার মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচারক ও সতর্ককারী পাঠানো হয়েছে, যদিও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার উদ্দেশে পৃথকভাবে নবী পাঠানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা বলে, তাঁর প্রতি [মহানবী (সা.)] তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? তুমি তো শুধু সতর্ককারী। আর প্রত্যেক জাতির জন্যই সতর্ককারী আছে। ’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ৭)

সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা ও আফ্রিকায় যদি কোনো নবী না-ও পাঠানো হয়ে থাকে, তবু কোরআনের বক্তব্য সত্য। কেননা এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে কোনো ধর্মপ্রচারক যাননি।

দ্বিতীয়ত, কোরআনের ভাষ্যমতে, একসময় গোটা মানবজাতি এক জাতি ছিল। পরে মানুষ বহু জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সব মানুষ একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে। আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মধ্যে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২১৩)

নূহ (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত মানবজাতি একই ভূখণ্ডে ছিল। সেটা ছিল মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। তাদের জন্য পৃথক পৃথক নবী এসেছেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। এর আলোকে বলা যায়, কোরআনের যেসব আয়াতে প্রত্যেক জাতির জন্য রাসুল আসার কথা বলা হয়েছে, সেটা ওই সব জাতির জন্য প্রযোজ্য। সেসব জাতির জন্য নবী- রাসুল আগমন করার বিষয়ে আসমানি ধর্মগ্রন্থ, বিশ্বের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনির বর্ণনায় সামঞ্জস্য আছে। কাজেই সব জাতির জন্য রাসুল আসার কথা চিরন্তন সত্য। এ কথার মাধ্যমে কোরআনের ওপর প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই।

Leopold Pospisil একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম The Kapauku Papuans Of West Guinea. পাপুয়া নিউগিনির একটি অঞ্চলে বসবাসকারী কিছু প্রস্তর যুগে থেকে যাওয়া মানুষের ব্যাপারে এই বইটি লেখা হয়েছে। তাদের বলা হয় কাফাউকু জাতি। এরা পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবমুক্ত ছিল অনেক বছর। সর্বপ্রথম তারা ১৯৩৮ সালে পশ্চিমা সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। তাদের বেশির ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ৫০০ মিটার ওপরে অবস্থিত, যার চারপাশ দুর্গম পর্বতসংকুল আর খাড়া গিরিপথে ঘেরা। ওই বইয়ে তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, The Kapauku has an interesting world view. If we have to compare their religion versus Islam! অর্থ : ‘কাফাউকুদের বিশ্বদর্শন আছে, তাদের ধর্মবিশ্বাসকে আমি ইসলামের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। ’ সে বিশ্বাস কী ধরনের। তার একটি নমুনা রয়েছে ওই বইয়ে। সেখানে রয়েছে : The universe itself and all existence was Ebijata, ‘designed by Ugatame’, the Creator. অর্থ : ‘মহাবিশ্ব আর এর অভ্যন্তরস্থ সব বস্তু ছিল অস্তিত্বহীন। পরে সেগুলো অস্তিত্বে আনেন Ugatame বা স্রষ্টা। 

- তাই বলা যায়, পৃথিবীর ইতিহাস যথাযথ সংরক্ষিত থাকলে স্পষ্টভাবে বলা যেত যে কোন জাতির কাছে কোন নবী এসেছেন। 

➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖

► আপনার যদি পোস্টটি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই বেশী বেশী প্রচার করুন। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন,“যে ব্যক্তি মানুষকে হিদায়াতের দিকে ডাকে তার জন্য ঠিক ঐ পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ পাবে তাকে অনুসরণকারীরা।”

[সহীহ মুসলিম, হাদিস নাম্বারঃ ২৬৭৪,৬৮০৪]

▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

No comments:

Post a Comment

হায় মুমলমান ! তোমরা কত বোকা ।

এপ্রিল ইংরেজী বর্ষের চতুর্থ মাস , ফুল (FOOL) একটি ইংরেজী শব্দ , যার অর্থ বোকা । এপ্রিল ফুলের অর্থ ‘এপ্রিলের বোকা’ । “এপ্রিল ফুল” ইতিহাসের এক...