Saturday, December 26, 2020

হিংসা করে কখনো লাভবান হওয়া যায়না

অপরের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থের চিন্তা করে আপনি হয়ত লাভবান হতে পারেন!

অপরকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিজেকে বিজ্ঞ ভাবতে পারেন!

কিন্তু এ-র প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আপনি চিরকাল ঘৃণার পাত্রই থেকে যাবেন। লোক দেখানো সম্মান পেলেও অন্তর থেকে শ্রদ্ধা পাবেননা।

Monday, October 19, 2020

দারসুল কুরআন (সূরা আল মুদ্দাসসির, আয়াত : ১-৭

 اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
ياَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ ০ قُمْ فَاَنْذِرْ ০ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ ০ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ০ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ ০ وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ ০ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ ০
২। ভাবানুবাদ
‘ওহে আবৃত ব্যক্তি, উঠ এবং (লোকদেরকে) সাবধান কর। এবং তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর। এবং তোমার পোশাক পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখ। এবং যাবতীয় মলিনতা থেকে দূরে থাক। এবং বেশি পাবে আশায় অনুগ্রহ করো না। এবং তোমার রবের খাতিরে ছবর অবলম্বন কর।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
ইতিহাস বিশ্লেষকরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাব কালকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সন্দেহ নেই, সেই যুগের জন্য এই আখ্যাটিই যথার্থ।
সেই যুগটি ছিলো মানব সমাজ ও সভ্যতার অতি অধপতিত একটি অধ্যায়।
দেশে দেশে তখন রাজা আর সম্রাটদের দোর্দন্ড প্রতাপ। তারা মানুষের প্রভু সেজে বসেছিলো। তাদের খেয়াল-খুশিই ছিলো আইন। আইনের শাসন বলতে যা বুঝায় তখন তা ছিলো এক কল্পনাতীত বিষয়।
রাজা বা সম্রাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো একটি অভিজাত শ্রেণী। তাদের আর জনগণের মাঝে ছিলো দুস্তর ব্যবধান। তারা জনসাধারণকে ঘৃণার চোখে দেখতো। কিন্তু তাদের বিলাসী জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ঐ সাধারণ মানুষগুলো থেকেই আদায় করা হতো।
হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজা বা সম্রাট এবং তাদের অনুগ্রহভাজন অভিজাত গোষ্ঠী ছিলো মদখোর। মদ খেয়ে মাতলামী করা আর নিত্য নতুন নারী দেহ ভোগ করা ছিলো তাদের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই বিপুল সংখ্যক নারীকে হতে হয়েছে বেহায়া এবং উলংগ কিংবা অর্ধ-উলংগ।
সেই যুগে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো অসহনীয়। সেটি ছিলো সুদখোরদের স্বর্ণ যুগ। কিছু সংখ্যক পুঁজিপতি সুদের মাধ্যমে অগণিত মানুষের কাছ থেকে টাকা ছেঁকে নিয়ে গড়তো টাকার পাহাড়। পুঁজিপতিরা হতো ‘আংগুল ফুলে কলাগাছ’। ঋণ গ্রহীতারা হতো কংকালসার।
সেই যুগে পৃথিবীর সকল দেশেই গরু, ছাগল, উট, ভেড়ার মতো মানুষ বেচা-কেনার জন্যও হাট বসতো। এক বিত্তবান ব্যক্তির কাছ থেকে আরেক বিত্তবান ব্যক্তি কিনে নিতো দাস-দাসী। এরা রাতভর-দিনভর শ্রম দিতো মনিবের বাড়িতে, বাগানে, খামারে কিংবা কারখানায়। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় ছিলো মৃত্যু।
সেই যুগে নারীদের দুর্ভোগের অন্ত ছিলো না। নারীদের একমাত্র কর্তব্য ছিলো পুরুষদের যৌন ক্ষুধা মেটাতে থাকা। একজন পুরুষ যতো সংখ্যক ইচ্ছা বিয়ে করতে পারতো। আবার বিত্তবান হলে রক্ষিতা হিসাবে রাখতে পারতো অসংখ্য নারী। কোন কোন অঞ্চলে পিতার মৃত্যুর পর পুত্ররা তাদের সৎ-মা’দেরকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতো। কোন কোন অঞ্চলে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে মেরে অথবা জীবিতাবস্থায় গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হতো।
রাজা বা সম্রাটরা ওঁত পেতে থাকতো পররাজ্য আক্রমণের জন্য। পররাজ্য দখল করে সেখানে তারা তাদের প্রভুত্ব চাপিয়ে দিতো, দুই হাতে লুটে নিতো দখলকৃত দেশের সম্পদ, যুবকদেরকে করতো হত্যা, আর যুবতীদেরকে ধরে নিয়ে যেতো তাদের যৌবন রস আস্বাদনের জন্য।
সেই যুগে সামগ্রিকভাবে মানুষের জান, মাল ও ইয্যাতের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি ইত্যাদি ছিলো নিত্য-দিনের ঘটনা।
তদুপরি এটি ছিলো চরম ধর্মীয় বিকৃতির যুগ। মাক্কায় অবস্থিত তাওহীদের কেন্দ্র কা‘বায় স্থাপিত হয়েছিলো ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি। মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য এদের কাছে প্রার্থনা করা হতো। এদের উদ্দেশ্যে উট, ভেড়া, বকরি বলি দেওয়া হতো।
আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত যিয়ারাতকারীরা উলংগ হয়ে কা‘বার তাওয়াফ করতো। আরবের মুশরিকদের ছালাত সম্পর্কে সূরা আল আনফালের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاء وَتَصْدِيَةً০
‘তাদের ছালাত ছিলো বাইতুল্লাহর কাছে শিস দেওয়া আর হাত তালি দেওয়া।’
আরবের পূর্ব দিকে ছিলো ইরান সাম্রাজ্য। কল্পিত দেবতা আহুর মাজদা ছিলো ইরানীদের সবচে’ বড়ো উপাস্য। তাদের ধারণায় আহুর মাজদা-র প্রকাশ ঘটতো আগুনের শিখার মাঝে। তাই পুরোহিত কর্তৃক প্রজ্জলিত আগুনের অনির্বাণ শিখার উদ্দেশ্যে তারা সাজদা করতো।
আরবের উত্তরে ছিলো বিশাল রোমান সামাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যে তখন সেন্ট পল কর্তৃক উদ্ভাবিত খৃস্টবাদের বেশ প্রসার ঘটে। সেন্ট পল ছিলেন ত্রিত্ববাদের প্রবক্তা। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত মারইয়াম (রা) এবং ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও (আলাইহিস সালাম) খৃস্টানদের উপাস্যে পরিণত করে।
কালক্রমে খৃস্টানগণ দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি ভাগ বৈরাগ্যবাদকে তাদের জীবনাদর্শ বানিয়ে নেয়। অপর ভাগটি ভোগবাদী হয়ে পড়ে। বৈরাগ্যবাদী খৃস্টানগণ গোসল না করা, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক পরা, গোশত-রুটি না খাওয়া ইত্যাদিকে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতো। পক্ষান্তরে, ভোগবাদী খৃস্টানগণ ভুরিভোজ, মদপান ও অবাধ যৌনাচারে মত্ত হয়ে পড়ে। তাদের মদের আসরে উর্ধ্ব-উলংগ নর্তকীরা নাচতো ও গান গাইতো। সুগন্ধি দ্রব্য জ্বালিয়ে গোটা পরিবেশকে উত্তেজক করে তোলা হতো।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে মূসা ইবনু ইমরান (আলাইহিস সালাম)-এর অনুসারী বলে দাবি করতো। প্রকৃতপক্ষে তারা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি নাযিলকৃত আত্ তাওরাতের অনুসারী ছিলো না। বরং তারা আত্ তাওরাতকে বিকৃত করে ফেলেছিলো এবং বহু হারামকে হালাল বানিয়ে নিয়েছিলো। মুজাদ্দিদ উযাইরকে (রাহ) তারা আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করতো।
সামগ্রিকভাবে তখন গোটা পৃথিবী ছিলো জাহিলিয়াতের পদানত।
সেই যুগে দুই চারজন বিবেকবান ব্যক্তি যে ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁরা ছিলেন অসহায়। তদুপরি অধপতিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেংগে নতুন সমাজ বিনির্মাণের কোন নীতিমালা ও কলা-কৌশল তাঁদের জানা ছিলো না।
এই মহা দুর্দিনে পৃথিবীবাসীকে মুক্তির পথ বাতলাবার জন্য আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটান। তিনিই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কা শহরেই জন্মগ্রহণ করেন এবং বর্ধিত হন। তিনি যখন ১৭ বছরের তরুণ, তখন তাঁর চাচা আযযুবাইর ইবনু আবদিল মুত্তালিব কিছু বিবেকবান ব্যক্তিকে নিয়ে একটি মিটিং করেন। আবদুল্লাহ ইবনু জুদআনের ঘরে অনুষ্ঠিত হয় সেই মিটিং। বানু হাশিম, বানু জুহরাহ, বানু তাইম এর বেশ কিছু সদস্য এতে উপস্থিত ছিলেন। আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা একটি সংস্থা গঠন করেন। এই সংস্থার নাম রাখা হয় হিলফুল ফুদুল। এর পাঁচ দফা কর্মসূচি ছিলো নিম্নরূপ-
 আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো।
 আমরা মুসাফিরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।
 আমরা অভাবীদেরকে সাহায্য করবো।
 আমরা মাযলুমের সাহায্য করবো।
 আমরা কোন যালিম ব্যক্তিকে মাক্কায় আশ্রয় দেবো না।
তরুণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ উৎসাহ নিয়ে এই সংস্থার সদস্য হন এবং সমাজে একটি কল্যাণ ধারা সৃষ্টির প্রয়াসে নিয়োজিত থাকেন। ২৩ বছর ধরে চলে এই প্রয়াস। দেখা গেলো ২৩ বছর আগে সমাজ যেই তিমিরে ছিলো ২৩ বছর পর সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাবুক প্রকৃতির হয়ে ওঠেন। তিনি নির্জনতা পছন্দ করতে শুরু করেন। এই সময়টি সম্পর্কে আয়িশা আছ ছিদ্দিকা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘আল্লাহ যখন রাসূলুল্লাহকে সম্মানিত এবং মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে চাইলেন তখন রাসূলুল্লাহ নবুওয়াতের অংশ হিসেবে স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা সূর্যোদয়ের মতো সত্য হতো। এই সময় আল্লাহ তাঁকে নির্জনে অবস্থানের প্রতি আগ্রহী করে দেন। নির্জনতা তাঁর প্রিয় ওঠে।’
এই নির্জনতা প্রীতি ও নিভৃত অবস্থানেরই নাম ‘তাহান্নুস’।
নিভৃতে একাকীত্বে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেছে নেন জাবালুন্ নূরের হেরা গুহাটি। তিনি কয়েক দিনের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে হেরা গুহায় চলে যেতেন। খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেলে গুহা থেকে নেমে ঘরে এসে আবার কয়েক দিনের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে চলে যেতেন।
উল্লেখ্য, জাবালুন্ নূর কা‘বা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে হেরা গুহা পর্যন্ত উঠতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গুহা পর্যন্ত পৌঁছা সহজ কাজ নয়। নিভৃতে আল্লাহর ইবাদাতে কাটাবার জন্য তিনি এই গুহাটিকেই বেছে নেন।
এই অবস্থাতেই একদিন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) হেরা গুহায় এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’ জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’ জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) ‘তাঁকে আবার বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’
তৃতীয়বার তাঁকে বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) বলেন,
اِقْرَأ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ০ خَلَقَ الاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ০ اِقْرَأ وَرَبُّكَ الاَكْرَمُ ০ الَّذِىْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ০ عَلَّمَ الاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ০
‘পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড় এবং তোমার রব বড়োই অনুগ্রহশীল। যিনি কলম দ্বারা জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।’
এবার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরাঈল (আলাইহিস সাল্লাম)-এর সাথে আয়াত গুলো উচ্চারণ করলেন এবং এই গুলো তাঁর অন্তরে গেঁথে গেলো।
অতপর জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) চলে যান। ভীত কম্পিত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেরা গুহা থেকে নেমে ঘরে ফেরেন এবং স্ত্রী খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদকে (রা) ডেকে বলেন, ‘যাম্মিলুনী যাম্মিলুনী।’ (আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও, আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও)।
ভীতি ভাব কেটে গেলে তিনি বললেন, ‘‘খাদীজা, আমার কী হয়ে গেলো। আমার তো জীবনের ভয় ধরে গেছে।’’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘‘আপনি আশ্বস্ত হোন। আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনোই লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন, আমানাতের হিফাযাত করেন, অসহায় লোকদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিজে উপার্জন করে অভাবীদেরকে দান করেন। আতিথ্য রক্ষা করেন এবং ভালো কাজে সহযোগিতা করেন।’’
সূরা আল ‘আলাকের এই পাঁচটি আয়াত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত প্রথম ওহী।
ঈসায়ী ৬১০ সনের রমাদান মাসে এই আয়াত গুলো নাযিল হয়। এই আয়াতগুলোতে সৃষ্টি জগতের মহান স্রষ্টা আল্লাহ কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চার আহবান জানানো হয়েছে। মাতৃগর্ভে সন্তানের উন্মেষ হওয়ার প্রথম কয়েকটি দিন জরায়ু গাত্রে ঝুলে থাকা অতি ছোট্ট একটি রক্ত পিন্ড থেকে যে মানুষের যাত্রা শুরু, সেই জ্ঞান তাঁকে দেওয়া হয়েছে। তদুপরি নগণ্য অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষ যে অসামান্য অবস্থায় উন্নীত হয়, সেই সম্পর্কেও তাঁকে অবহিত করা হয়েছে।
এই আয়াত কয়টিতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে নবী বানানো হয়েছে সেই ধারণা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর করণীয় কী তা এই আয়াতগুলোতে বলা হয়নি।
প্রথম ওহী নাযিলের পর কেটে যায় কয়েকটি মাস। এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন মাক্কার একটি পথ ধরে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওপর থেকে একটি আওয়াজ ভেসে আসে। উপরের দিকে তাকিয়ে তিনি জিবরাঈলকে (আলাইহিস সালাম) দেখতে পান এবং দ্রুত কদমে ঘরে ফিরে স্ত্রীকে বলেন, ‘‘যাম্মিলুনী যাম্মিলুনী।’’
গায়ে কম্বল জড়িয়ে তিনি শুয়ে পড়েন। কিন্তু জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সংগ ছাড়লেন না। তিনি সূরা আল মুদ্দাসসিরের এই সাতটি আয়াত আবৃত্তি করলেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়াত গুলো পড়লেন এবং এই গুলো তাঁর অন্তরে গেঁথে গেলো।
৪। ব্যাখ্যা
 ياَيَّهَا الْمُدَّثِّرُ.
এটি এই সূরার প্রথম আয়াত। এই আয়াতের ‘মুদ্দাসসির’ শব্দটি নিয়ে এই সূরার নাম করণ করা হয়েছে।
এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘ওহে আবৃত ব্যক্তি’ অথবা ‘ওহে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি।’
এটি একটি প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন ‘ইয়া মুহাম্মাদু’ কিংবা ‘ইয়া আইউহান্নাবীউ’ বলেও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করতে পারতেন। তা না করে তিনি এই প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন ব্যবহার করাটাই পছন্দ করেছেন।
 قُمْ فَاَنْذِرْ.
এটি এই সূরার দ্বিতীয় আয়াত। এর অর্থ ‘ওঠ, এবং (লোকদেরকে) সাবধান কর।’
এই আয়াতের মাধ্যমে নবী হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যতম কর্তব্য নির্দেশ করা হয়েছে।
قُمْ শব্দের অর্থ ‘ওঠ’। আবার এর অর্থ হয় ‘দাঁড়াও’, ‘কর্তব্য কর্মে নেমে পড়’।
فَاَنْذِرْ অর্থ ‘লোকদেরকে সাবধান কর।’
অর্থাৎ লোকেরা স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে একদিকে দুনিয়ার জীবনে অশান্তি ভোগ করছে, অপর দিকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে চিরন্তন শাস্তি ভোগ করা সুনিশ্চিত করছে। অতএব এই বিষয়ে তুমি তাদেরকে সতর্ক কর। তাদেরকে স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করতে বল।
 وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ .
অর্থ ‘এবং তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর।’
এটি এই সূরার তৃতীয় আয়াত। এই আয়াতটি অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। ছোট্ট দুইটি শব্দের মাধ্যমে নবী হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রধান কর্তব্য কী তা তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে। আর সেই সুমহান কর্তব্যটি হচ্ছে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা ও প্রতিষ্ঠা করা।
মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ। মহাবিশ্ব আল্লাহর বিধান মেনে চলে আল্লাহরই বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি প্রদান করছে। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ। মানুষের কর্তব্য আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলে আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি প্রদান করা।
কিন্তু মানুষ নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপর কোন মানুষ কিংবা অপর কোন সৃষ্টিকে বড়ো কিংবা শ্রেষ্ঠ মনে করে তার বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এটি মানুষের জন্য সমীচীনও নয়, শোভনীয়ও নয়।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবকালে সামগ্রিকভাবে গোটা মানবগোষ্ঠী এই অসমীচীন ও অশোভনীয় কাজটিই করছিলো। এমতাবস্থায় আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নির্দেশ দিলেন, ‘ওয়া রাববাকা ফা-কাবিবর’ (তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর)। উল্লেখ্য যে বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব শব্দটির সমভাব প্রকাশক আরেকটি শব্দ হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এই ছোট্ট আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করে তাঁরই প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের জন্য মানবগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাবার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেওয়া হয়।
وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ. 
অর্থ ‘এবং তোমার পোশাক পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখ।’
এটি এই সূরার চতুর্থ আয়াত।
طَهِّرْ শব্দটি ‘তুহরুন’ বা ‘তাহারাত’ শব্দ থেকে উৎসারিত। ‘তুহরুন’ বা ‘তাহারাত’ শব্দটি যুগপৎ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্থ প্রকাশ করে।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বভাবগত ভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতেন। তিনি যেন সচেতনভাবে এবং কর্তব্য মনে করে তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখেন তারই শিক্ষা রয়েছে এই আয়াতে।
নৈতিক দিক দিয়ে পোশাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার অর্থ হচ্ছে, পোশাক এমন হতে হবে যাতে অহংকার প্রকাশ পাবে না, তাতে কুরুচির ছাপও থাকবে না। উল্লেখ্য যে এই আয়াতের শিক্ষা পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। মুমিনদের বিছানার চাদর, বালিসের কাভার, দরওয়াজা-জানালার পর্দা, আসবাব পত্র, গৃহের অভ্যন্তর এবং বহিরাংগন পরিচ্ছন্ন রাখাও এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ نَظِيْفٌ يُحِبُّ النَّظَافَةَ....فَنَظِّفُوْا اَفْنِيَتَكُمْ.
[ছালিই ইবনু আবি হাসসান (রহ), জামে আত তিরমিযী, হাদীস নাম্বার-২৭৩৬]
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালো বাসেন।... অতএব তোমরা তোমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখ।’’
وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ.
অর্থ ‘এবং যাবতীয় মলিনতা থেকে দূরে থাক।’
এটি এই সূরার পঞ্চম আয়াত। এটিও একটি ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত।
চিন্তা-চেতনায়, আচার-আচরণে এবং যাবতীয় কর্মকান্ডে জাহিলিয়াতের মলিনতার সামান্যতম ছোঁয়াও যেন লাগতে না পারে সেই জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক থাকার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ.
অর্থ ‘এবং বেশি পাবে আশায় অনুগ্রহ করো না।’
এটি এই সূরার ষষ্ঠ আয়াত। আল্লাহর সার্বভৌমতেবর স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়াসে নিয়োজিত ব্যক্তির জন্য এটি আবশ্যিকভাবে অনুসরণীয় একটি নীতি।
মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া, মানুষকে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের দিকে টেনে আনা, মানুষের প্রতি অতি বড়ো অনুগ্রহ।
এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, এই বিরাট অনুগ্রহের কাজটি করতে হবে শুধু আল্লাহর জন্য, অন্য কারো কাছ থেকে কোন রূপ বিনিময় পাওয়ার জন্য নয়। পরিপূর্ণ নিঃস্বার্থতাসহকারে এই কাজ করতে হবে, কোনরূপ বৈষয়িক স্বার্থ-সুবিধা লাভের আশা মনে পোষণ করা যাবে না।
এই শিক্ষা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অন্য সব নবী-রাসূলকেও দিয়েছিলেন। তাই তো আমরা তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুনি,
وَمَآ اَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ ج اِنْ اَجْرِىَ اِلاَّ عَلى رَبِّ الْعلَمِيْنَ .
‘আমি তো তোমাদের কাছে এই কাজের কোন বিনিময় চাচ্ছি না। আমার বিনিময় তো রয়েছে রাববুল ‘আলামীনের নিকট।’
নূহ (আলাইহিস সালাম) কুর্দিস্তান-এর অধিবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ১০৯),
হূদ (আলাইহিস সালাম) ‘আদ জাতিকে (আশ্ শূ‘আরা, ১২৭),
ছালিহ (আলাইহিস সালাম) ছামুদ জাতিকে (আশ্ শূ‘আরা, ১৪৫),
লূত (আলাইহিস সালাম) ট্রান্সজর্ডনের অধিবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ১৪৬),
এবং শু‘আইব (আলাইহিস সালাম) মাদ্ইয়ানবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ‌১৮০),
সম্বোধন করে এ কথাই বলেছিলেন।
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ.
এটি এই সূরার সপ্তম আয়াত। এটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবেমাত্র নবুওয়াতের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা হলো। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়ার ডাক তিনি এখনো দেননি। ফলে ময়দানে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যায়নি। তথাপিও আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অগ্রিম জানিয়ে দিলেন যে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য-পালন করতে গেলে তাঁকে বাধা-প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। চলার পথের বাঁকে বাঁকে কঠিন পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে হবে। বাধা যতোই কঠিন হোক না কেন, পরিস্থিতি যতোই ভীতিপ্রদ হোক না কেন তাঁকে কর্তব্য কর্মে দৃঢ়পদ থাকতে হবে।
৫। শিক্ষা
 মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব তথা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদেরকে নিবেদিত হতে হবে।
 আমাদের পোশাক হতে হবে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল এবং গর্ব অহংকারের ছাপমুক্ত। আমাদের গৃহাংগন ও গৃহের পার্শ্বস্থ অংগনও হতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
 আমাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ এবং যাবতীয় কর্মকান্ড হতে হবে জাহিলিয়াতের মলিনতার ছোঁয়া মুক্ত।
 আমাদেরকে আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, কোনরূপ বৈষয়িক স্বার্থ সুবিধা লাভের আশা থেকে মনকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত রেখে।
 আমাদেরকে বিরোধিতা, বাধা-বিপত্তি এবং কঠিন পরিস্থিতির মুকাবিলায় আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ছবর অবলম্বন করতে হবে।

--০--

 এ.কে.এম.নাজির আহমদ


দারসুল কুরআন (সূরা আলে-ইমরান আয়াত : ১৫৯)

اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنْتَ لَهُمْ ط وَلَوْكُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ص فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِى الاَمْرِ ج فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ ط اِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি নম্ন হয়েছো। যদি তুমি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে তারা তোমার চারদিক থেকে সরে যেতো। অতএব তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাদের জন্য ইসতিগফার কর এবং সামষ্টিক বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতপর যখন তুমি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করে।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
নবুওয়াত লাভের পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কাতে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ করতে থাকেন।
সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিলো তাঁর প্রয়াস। কিন্তু ইসলাম-বিদ্বেষীরা এই শান্তিপূর্ণ প্রয়াসকেও বরদাশত করতে পারেনি। নানা ধরণের বানোয়াট কথা প্রচার করে তারা লোকদের মনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রচারিত দীন সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সত্য সন্ধানী যুবক যুবতীরা এই অপ প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে একে একে ইসলামের পথে এগিয়ে আসে। এতে ইসলাম-বিদ্বেষীরা মারমুখো হয়ে ওঠে এবং মুসলিমদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। মুশরিক নেতাদের বৈরিতার কারণে মাক্কার যমিন মুসলিমদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অনুগ্রহে ইয়াসরিবে ইসলামের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়। অচিরেই ইয়াসরিবে গড়ে ওঠে ইসলামের অনুকূল গণ-ভিত্তি। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি রাষ্ট্র ‘আল মাদীনা আল মুনাওয়ারা। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আলোকে তিনি সমাজের সকল দিক ও বিভাগে আমূল পরিবর্তন সাধনে হাত দেন।
সবেমাত্র একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মাক্কার মুশরিক নেতারা আল মাদীনায় নতুন এক রাষ্ট্র শক্তির বিকাশে শংকিত হয়ে ওঠে। তারা এই রাষ্ট্রশক্তিকে অংকুরেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এক হাজার সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে আল-মাদীনার দিকে অগ্রসর হয়।
মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ নিয়ে আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর প্রান্তরে তাদের মুকাবিলা করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন মুসলিম শহীদ হন। কেউ বন্দী হননি। পক্ষান্তরে মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন যোদ্ধা নিহত হয়। বন্দী হয় ৭০ জন।
এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হিজরী তৃতীয় সনে আল মাদীনার উহুদ প্রান্তরে এসে পৌঁছে মাক্কার তিন হাজার মুশরিক যোদ্ধা। এদের মুকাবিলা করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে উহুদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত যোদ্ধা নিয়ে সরে পড়ে।
মাত্র ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিক বাহিনীর সম্মুখীন হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে জয় লাভ করে। উল্লসিত হয়ে মুজাহিদদের একটি অংশ গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রুমাত পাহাড়ে পাহারায় নিয়োজিত ৫০ জন তীরন্দাজের বেশির ভাগই তাদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করে গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসে। অথচ তাদের প্রতি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ ছিলো ‘কোন অবস্থাতেই স্থান ত্যাগ করা যাবে না।’
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ তখনো মুশরিক। পাহারাদার মুসলিমদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করার বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। একদল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তিনি হঠাৎ মুসলিমদের ওপর চড়াও হন। এই আকস্মিক আক্রমণে মুসলিমগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহত হন। আহত হন শত শত মুজাহিদ।
এই যুদ্ধের পর মুসলিমদেরকে নছীহাত করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এক দীর্ঘ ভাষণ নাযিল করেন। সূরা আলে ইমরানের ১২১ থেকে ২০০ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত এই ভাষণ বিস্তৃত। এই ভাষণের একাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلاَ تَهِنُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَاَنْتُمُ الاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ ০
(আয়াত : ১৩৯)
‘তোমরা মন-ভাংগা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হও।’
যুদ্ধের ময়দানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহীদ হয়েছেন এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে বহুসংখ্যক মুজাহিদ হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তাদের এই ভূমিকার নিন্দা করে এই ভাষণে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
وَمَا مُحَمَّدٌ اِلاَّ رَسُوْلٌ ج قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ ط اَفَاْئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلى اَعْقَابِكُمْ ط وَمَنْ يَّنقَلِبْ عَلى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللّهَ شَيْئًا ط وَسَيَجْزِِى اللّهُ الشّكِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৪)
‘মুহাম্মাদ তো একজন রাসূল বৈ কিছু নয়। তার আগে আরো অনেক রাসূল চলে গেছে। সে যদি মারা যায় তোমরা কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? যেই ব্যক্তি পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শিগগিরই তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’
এই ভাষণের একাংশে অতীতের কিছু আল্লাহ ওয়ালা লোকের যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা অবলম্বনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَكَاَيِّنْ مِّنْ نَّبِىٍّ قتَلَ لا مَعَه رِبِّيُّوْنَ كَثِيرٌ ج فَمَا وَهَنُوْا لِمَا اَصَابَهُمْ فِىْ سَبِيلِ اللّهِ وَمَا ضَعُفُوْا وَمَا اسْتَكَانُوْا ط وَاللّهُ يُحِبُّ الصّبِرِيْنَ০ وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلاَّ اَنْ قَالُوْا ربَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَاِسْرَافَنَا فِىْ اَمْرِنَا وَثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكفِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৬-১৪৭)
‘এর আগে এমন নবী চলে গেছে যার সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লোক লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়ে তারা মনভাংগা হয়নি, দুর্বলতা দেখায়নি এবং বাতিলের সামনে মাথা নত করেনি। এই ধরনের ছবর অবলম্বনকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন। তাদের দু‘আ এই ছিলো-
‘হে আমাদের রব, আমাদের গুনাহ মাফ করে দিন, আমাদের সীমা লংঘন মাফ করে দিন, আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন এবং কাফিরদের মুকাবিলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
অতপর এই ভাষণে উহুদ প্রান্তরে মুমিনদের প্রদর্শিত দুর্বলতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللّهُ وَعْدَهَ اِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ بِاِذْنِه جِ حَتّى اِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِى الاَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِّنْم بَعْدِ مَا اَرـكُمْ مَّا تُحِبُّوْنَ ০
(আয়াত : ১৫২)
‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে সাহায্যের ওয়াদা করেছিলেন তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে তোমরা তাদেরকে হত্যা করছিলে। কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে, তোমাদের কর্তব্য-কর্ম সম্পর্কে মতবিরোধে লিপ্ত হলে এবং যখন আল্লাহ তোমরা যা ভালোবাস (পার্থিব সম্পদ) তা তোমাদেরকে দেখালেন তোমরা নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে।’
এই ভাষণের একাংশে মৃত্যু সম্পর্কে কাফিরদের বিভ্রান্তিকর উক্তিতে প্রভাবিত না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَقَالُوْا لاِخْوَانِهِمْ اِذَا ضَرَبُوْا فِى الاَرْضِ اَوْ كَانُوْا غُزًّى لَّوْ كَانُوْا عِنْدَنَا مَا مَاتُوْا وَمَا قُتِلُوْا ج لِيَجْعَلَ اللّهُ ذلِكَ حَسْرَةً فِى قُلُوْبِهِمْ ط وَاللّهُ يُحْى وَيُمِيتُ ط وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ০ وَلَئِن قُتِلْتُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللّهِ اَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ ০
(আয়াত : ১৫৬-১৫৭)
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কাফিরদের মতো কথা বলো না। তাদের আত্মীয়দের কেউ সফরে বের হলে কিংবা যুদ্ধে অংশ নিলে (কোন দুর্ঘটনা আপতিত হলে) বলে, ওরা যদি আমাদের কাছে থাকতো, তাহলে মারা পড়তো না কিংবা নিহত হতো না। তাদের কথাকে আল্লাহ তাদের মনের খেদ ও আক্ষেপের কারণ বানিয়ে দেন। অথচ আল্লাহই জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ দেখেন। তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মারা যাও, অবশ্যই তোমরা আল্লাহর মাগরিফাত ও রাহমাত পাবে যা উত্তম ওরা যা কিছু জমা করছে তা থেকে।’
অতপর আলোচ্য আয়াতে (১৫৯ নাম্বার আয়াতে) এসে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন এবং সর্বাবস্থায় তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ প্রদান করেন।
৪। ব্যাখ্যা
আলোচ্য আয়াতের শুরুতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ .
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি বিনম্র হয়েছো।’
لِيْنٌ অর্থ নম্রতা, কোমলতা। لِنْتَ শব্দটি لِيْنٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
এই আয়াতাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নম্র বা কোমল আচরণকে সপ্রশংস ভংগিতে প্রকাশ করেছেন। এটাও তিনি উল্লেখ করেছেন যে আল্লাহর অনুগ্রহেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটি করতে পেরেছেন। তার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর অনুগ্রহ সিক্ত বা অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই অনুগামীদের প্রতি নম্র বা কোমল আচরণ করা সম্ভব।
অনুগামীদের প্রতি নম্র আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন সূরা আশ্ শূ‘আরা-র ২১৫ নাম্বার আয়াতে বলেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُوْمِنِيْنَ .
‘তোমার অনুগামী মুমিনদের প্রতি তোমার ডানা নুইয়ে দাও।’ অর্থাৎ তাদের সাথে নম্র আচরণ কর।
নম্র আচরণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِى الاَمْرِ كُلِّهِ .
(আয়িশা (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি সকল কাজেই কোমলতা পছন্দ করেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ اَوْحى اِلَىَّ اَنْ تَوَاضَعُوْا حَتّى لاَ يَفْخَرَ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ.
(ইয়াদ ইবনুল হিমার (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘আল্লাহ আমার নিকট ওয়াহী পাঠিয়েছেন যে তোমরা পরস্পর নম্র আচরণ কর, কেউ কারো ওপর গৌরব করো না, কেউ কারো ওপর বাড়াবাড়ি করো না।’
تَوَاضُعٌ অর্থ বিনয়, নম্রতা। تَوَاضَعُوْا শব্দটি تَوَاضُعٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِّنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِِعَفْوٍ اِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ اَحَدٌ لِلّهِ اِلاَّ رَفَعَهُ اللّـهُ .
(আবু হুরাইরা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘দান দ্বারা সম্পদ কমে না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ বান্দার ইযযাত বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনম্র আচরণ করলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اَلاَ اَخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَّحْرُمُ عَلَى النَّارِ اَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ تَحْرُمُ عَلى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لََيِّنٍ سَهْلٍ .
(আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা), জামে আততিরমিযী।)
‘আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করবো না কোন্ ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম অথবা কার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম। জাহান্নামের আগুন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য হারাম যে লোকদের সান্নিধ্যে থাকে, যে কোমলমতি, বিনম্র ও নরম মেজাজের অধিকারী।’
একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নছীহাত করতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ فَِايَّكَ اَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ .
(আয়িয ইবনু আমর (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘অবশ্যই নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তিরা যারা অনুগামীদের প্রতি কঠোর। সাবধান, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّمَا الاِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ َيُتَّقَى بِهِ فَاِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَ عَدَلَ كَانَ لَهُ بِذلِكَ أَجْرٌ وَاِنْ يَأمُرُ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ .
(আবু হুরাইরা (রা,) ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা ঢালের মতো। তার অধীনে থেকে লড়াই করা হয়। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সে যদি তার অনুগামীদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয় এবং তাদের মাঝে আদল প্রতিষ্ঠা করে তাহলে সে পুরস্কার পাবে, যদি এর বিপরীত কাজ করে তাহলে পাবে শাস্তি।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর আদালতে নেতৃত্বের জওয়াবদিহি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বলেন,
اَلاِمَامُ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَّعِيَّتِهِ .
(আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা একজন তত্ত্বাবধায়ক। তাকে তার নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধান সম্পর্কে জওয়াবদিহি করতে হবে।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَامِنْ اَمِيْرِ عَشَرَةٍ يُؤْتَى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَغْلُولاً حَتَّى يُفَكَّ عَنْهُ الْعَدْلُ اَوْ يُوْبِقَهُ الْجُوْرِ.
(আবু হুরাইরা (রা), সুনানু আদ্ দারেমী।)
‘কোন ব্যক্তি যদি দশজন লোকেরও নেতা হয়, কিয়ামাতের দিন তাকে বেড়ি লাগানো অবস্থায় হাজির করা হবে। (লোকদের পরিচালনাকালে) তার অনুসৃত ন্যায়নিষ্ঠতা এই অবস্থা থেকে তার মুক্তির কারণ হবে অথবা তার কৃত অন্যায় তার ধ্বংসের কারণ হবে।’
 অতপর আলোচ্য আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ .
‘তুমি যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে লোকেরা তোমার চার দিক থেকে সরে যেতো।’
নম্র আচরণ মানুষকে আকর্ষণ করে। পক্ষান্তরে রূঢ় আচরণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বস্ত্তত রুক্ষভাষা বা রূঢ় আচরণের উৎস হচ্ছে কঠোর চিত্ত।
এখানে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কঠোর চিত্ততা ও রুক্ষভাষার পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
নেতৃত্ব বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি কঠোর চিত্ত ও রুক্ষভাষী হন, অনুগামীগণ তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারা পারত পক্ষে তাঁর নিকটে ঘেঁষতে চায় না।
ইসলামী সংগঠনে, ইসলামী সমাজে এমন পরিবেশ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত।
 এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاعْفُ عَنْهُمْ .
‘তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
اَلْعَفْوَ বা ক্ষমাশীলতা অতি উচ্চমানের একটি গুণ। আল্লাহ চান, নেতৃত্বের আসনে আসীন প্রত্যেক ব্যক্তি এই গুণে গুণান্বিত হোক।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর অনুগামীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপ নির্দেশ আমরা দেখতে পাই সূরা আল আ‘রাফের ১৯৯ নাম্বার আয়াতে। আল্লাহ বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَاْمُرْ بِالْعُرْفِ وَاعَرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ .
‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, মা‘রূফ কাজের নির্দেশ দাও’ এবং জাহিলদেরকে এড়িয়ে চল।’
সূরা আল হিজরের ৮৫ নাম্বার আয়াতে তিনি বলেন,
فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيْلَ .
‘অতএব তুমি অতি সুন্দরভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
যদিও এইসব আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করা হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে ইসলামী সমাজের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্যই এই নির্দেশ।
যিনি মহান আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
اَللّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ .
(হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাকারী। আপনি ক্ষমা ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।)
তিনি তাঁর অনুগামী বা সহকর্মীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করবেন না, তা তো হতে পারে না।
 এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ .
‘এবং তাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
اَلاِسْتِغْفَارُ অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা।
এটিও মুমিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
সূরা মুহাম্মাদ-এর ১৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ .
‘এবং তুমি তোমার নিজের এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
ইসতিগফার-এর কল্যাণময়তা বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنَ كُلِّ ضِيْقٍ مَخْرَجًا وَّ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَّ رَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ .
(আবদুল্লাহ ইবনুল আববাস (রা), সুনানু আবী দাউদ।)
‘যেই ব্যক্তি সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে আল্লাহ তাকে প্রতিটি সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ করে দেন, প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেন এবং তার ধারণার অতীত উৎস থেকে তাকে রিযক দেন।’
অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করার ফযিলত সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لاَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مَسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لاَخِيْهِ بِخَيْرٍٍ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ امِيْنَ وَلَكَ بِمِثْلٍ .
(আবু দারদা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘ভাইয়ের অসাক্ষাতে কোন মুসলিম ব্যক্তির দু‘আ তার জন্য কবুল হয়। তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন এ ব্যক্তি তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দু‘আ করে তখন ঐ ফেরেশতা বলে, ‘আমীন, তোমার জন্যও অনুরূপ।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
خِيَارُ اَئِمَّتِِكُمُ الَّذِيْنَ تُحِبُّوْنَهُمْ وَيُحِبُّوْنَكُمْ وَتُصَلُّوْنَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّوْنَ عَلَيْكُمْ وَشِرَارُ اَئِمَّتِكُمُ الَّذِيْنَ تُبْغِضُوْنَهُمْ وَ يُبْغِضُوْنَكُمْ وَتَلْعَنُوْنهُمْ وَيَلْعَنُوْنَكُمْ .
(আওফ ইবনু মালিক (রা), ছাহীহ মুসলিম।)
‘তোমাদের উত্তম নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস, তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দু‘আ কর, তারাও তোমাদের জন্য দু‘আ করে।
তোমাদের মন্দ নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর, তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও, আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।’
ইসতিগফার-এর ফযিলত বুঝাতে গিয়ে সূরা আল আনফালের ৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ .
‘এটা আল্লাহর নিয়ম নয় যে লোকেরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’
 আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَشَاوِرْ هُمْ فِى الاَمْرُ .
‘এবং তাদের সাথে সামষ্টিক বিষয়ে পরামর্শ কর।’
اَلشُّوْرى অর্থ পরামর্শ।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসকালানী (রহ) বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করা শারীয়ার অন্যতম বিধান।’
আল হাসান ইবনু আবিল হাসান (রহ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, যেই জনগোষ্ঠী পরামর্শ করে কাজ করে তারা সর্বোত্তম পন্থার সন্ধান পেয়ে যায়।’
নবুওয়াতের পঞ্চম সনে নাযিলকৃত সূরা আশ্ শূরার ৩৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে الشُوْرى শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন,
وَاَمْرُهُمْ شُوْرى بَيْنَهُمْ .
‘তাদের সামষ্টিক বিষয় পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়।’
আর এই আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামষ্টিক বিষয়ে অনুগামীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি খুবই সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তথাপিও তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নভাবে তাঁর সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করতেন।
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর চেয়ে বেশি পরামর্শ করতে আর কাউকে দেখিনি।’
(জামে আত্ তিরমিযী, ৩য় খন্ড, হাদীস নাম্বার ১৬৫৯)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি রাতে ছালাতুল ইশার পর আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) ও উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে পরামর্শ করতেন।
আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তিনি ‘আশইয়াখে বাদরিন’ (বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ছাহাবী)দেরকে ডাকতেন এবং তাঁদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি যোদ্ধাদেরকে মাসজিদে নববীতে সমবেত করে যুদ্ধস্থল নির্ধারণ বিষয়ে পরামর্শ করেন।
পরামর্শ সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম কথা হচ্ছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত চেয়ারের পক্ষ থেকে রুলিং দেওয়া না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ একটি অভিমত, সিদ্ধান্ত নয়।
অভিমতের পক্ষে রুলিং দিলে তবেই তা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়।
 অতপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ ط
‘যখন তুমি সংকল্প গ্রহণ কর বা সিদ্ধান্তে উপনীত হও, তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর।’
عَزْمَةٌ অর্থ সংকল্প, সিদ্ধান্ত, করণীয় সম্পর্কে মনস্থির করে ফেলা।
নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে হতে হবে প্রশস্ত চিত্ত। অর্থাৎ তাকে উদার চিত্তে যতো বেশি সম্ভব লোকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
আবার, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্বকে হতে হবে দৃঢ় চিত্ত।
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর মন পুরোপুরি দোদুল্যমানতা মুক্ত করতে হবে।
একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে পরিপূর্ণ মানসিক বলিষ্ঠতা সহকারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে।
 আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।’
সূরা ইবরাহীম এর ১১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘এবং আল্লাহর ওপরই মুমিনদের তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
সুলা আল ফুরকান-এর ৫৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَتَوَكَّلْ عَلىَ الْحَىِّ الَّذِىْ لاَ يَمُوْتُ .
‘সেই চিরঞ্জীব আল্লাহর ওপরই তাওয়াককুল কর যিনি মরেন না।’
সূরা আত্ তালাক-এর ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ .
‘যেই ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট।’
تَوَكُّلْ অর্থ ভরসা, নির্ভরতা, নির্ভরশীলতা।
ইকামাতুদ্ দীনের জন্য মুমিনদেরকে যতো বেশি সম্ভব মানবসম্পদ এবং বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে। কিন্তু মুমিনদেরকে ইয়াকীন রাখতে হবে যে বিজয়ের চাবিকাঠি সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের হাতে।
এই কথাটি মুমিনদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করার জন্য আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنْ يَّنْصُرْكُمُ اللّـهُ فَلاَ غَالِبَ لِكُمْ ج وَاِنْ يَّخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَالَّذِىْ يَنْصُرُكُمْ مِّنْ مبَعْدِه ط وَ عَلىَ اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সাহায্য করেন, এমন কোন শক্তি নেই তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। আর তিনি যদি তোমাদেরকে পরিত্যাগ করেন, আর কে আছে তোমাদেরকে সাহায্য করার মতো! এবং মুমিনদের তো আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
অন্যত্র আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا النَّصْرُ اِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ . (আলে ইমরান ১২৬)
‘বিজ্ঞতাময় মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিকট থেকে ছাড়া অন্য কোথাও থেকে বিজয় আসে না।’
৫। শিক্ষা
১। অনুগামীদের ব্যাপারে কঠোর চিত্ততা পরিহার করতে হবে।
২। অনুগামীদের প্রতি রুক্ষভাষী হওয়া যাবে না।
৩। অনুগামীদের সাথে নম্র আচরণ করতে হবে।
৪। অনুগামীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করতে হবে।
৫। অনুগামীদের জন্য সর্বদা মাগফিরাতের দু‘আ করতে হবে।
৬। অনুগামীদের সাথে পরামর্শ আদান-প্রদান করতে হবে।
৭। পরামর্শের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হলে দৃঢ় চিত্ততা নিয়ে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮। যতো বেশি সম্ভব মানব সম্পদ ও বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে, কিন্তু তাওয়াক্কুল করতে হবে একমাত্র আল্লাহর ওপর। কেননা সাহায্য ও বিজয় একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই এসে থাকে।

হায় মুমলমান ! তোমরা কত বোকা ।

এপ্রিল ইংরেজী বর্ষের চতুর্থ মাস , ফুল (FOOL) একটি ইংরেজী শব্দ , যার অর্থ বোকা । এপ্রিল ফুলের অর্থ ‘এপ্রিলের বোকা’ । “এপ্রিল ফুল” ইতিহাসের এক...